আফরা ইবনাত
অর্ণা
১.
সকাল আট টা । হোস্টেলের বারান্দায় বসে হাতে বই
নিয়ে পড়ছিলো আর চা খাচ্ছিলো আনিলা । বান্ধবি সুভ্রা এসে পাশে দাড়ালো । শুভ্রা আনিলার দিকে তাকিয়ে বলল -
এবার বই থেকে চোখ নামান বিদ্যাসাগর
সাহেবা । কয়টা বাজে সে খেয়াল আছে ? ক্লাসে যেতে হবেনা ?
খুব অলস ভঙ্গিতে হাত ঘড়িটার দিকে
তাকিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পরলো আনিলা ।
আনিলা স্নাতক ২য় বর্ষের ছাত্রী ।
হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে সে । কোটি পতি বাবার একমাত্র সুন্দরি মেয়ে সে । তাই আনিলার বাবা মিস্টার শঙ্কর বোসের , মেয়েকে বিয়ে দেওয়া নিয়ে ছিলো খুব উৎসাহ । আনিলা বিয়ের ব্যাপারে মোটেই আগ্রহী না । । এমনিতে বাবাকে ভীষণ ভয় পেলেও বাবা যখন বিয়ের কথা বলতো তখন সে
বাবাকে সরাসরি না উত্তরটা দিয়ে দিতো ।
হোস্টেলে বান্ধবিদের সাথে ভালই দিন
পাড় করছিলো সে । পড়াশোনা , সবাই মিলে
আড্ডাবাজি বেশ ভালই কেটে যাচ্ছিলো সময় । একদিন আনিলাদের
বাড়ির বহুদিনের পুরনো চাকর হরিদাশ ফোন করে বলল – দিদিমনি,বাবু খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ।
আপনি আজই বাড়ি চলে আসুন , আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি । বাবার অসুস্থতার খবর শুনে আনিলা সেদিনই বাড়িতে চলে গেলো । বাড়ির দরজার সামনে যেতেই
আনিলা অবাক হয়ে গেলো । সারা বাড়িতে সাজ
সাজ রব । চারপাশে খুব সুন্দর করে সাজানো
হচ্ছে । আনিলা এসবের কিছুই বুঝতে পারলোনা । বাবার কাছে গিয়ে দেখলো বাবা সম্পূর্ণ সুস্থ । আনিলা খুব দ্রুত গতিতে বাবার সামনে
এগিয়ে গেলো ।
- বাবা,এসব কি হচ্ছে?
- শঙ্কর বোস গম্ভীর গলায় বলল,কাল তোর বিয়ে ।
- মানে ? আমাকে জানানোর দরকার মনে করলেনা একবারও
?
- তোকে জানালে তুই বেকে বসবি তাই এই সিদ্ধান্ত
নিতে বাধ্য হলাম । এখন আমি যা বলবো সেটাই মানতে হবে তোকে ।
আনিলার কাছে বিষয়টা যেন মাথায় যেন
আকাশ ভেঙ্গে পরার মতো ছিলো । এতো তারতারি বিয়ে করতে
চায় না সে । বাবাকে কিছু না বলে মনে মনে খুব দুঃখ পেয়ে
ভাবলো ,এইভাবে মিথ্যা বলে হোস্টেল থেকে নিয়ে এসে ধোঁকা দিলো সবাই ? আনিলা রাগে
গজরাতে গজরাতে হরিদাশের কাছে গিয়ে বলল-
হরিদা ,কাজটা কিন্তু মোটেই ঠিক
করলেনা তোমরা ।
-কি করবো বলো দিদিমনি,তুমি বিয়ে
করতে চাওনা বলেই তো তোমার বাবা এমন পদক্ষেপ নিলেন । বলেই চলে গেলো হরিদাশ । হরিদাশ
ঠিক কোন ভঙ্গিতে যে আনিলাকে কথাটা বলল ঠিক বুঝতে পারলনা আনিলা ।
আনিলা কোনো কথা না বলে নিজের ঘরে
গিয়ে দরজায় খিল তুলে দিলো । মন খারাপের প্রয়াস নিয়ে বিছানার এক কোনে জানালার পাশে
বসে আছে সে । ততক্ষনে সন্ধ্যা হয়ে
এসেছে । বসে বসে
ভাবতে লাগলো কি করে এ বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় । চট করে ওর মাথায় একটা বুদ্ধি
খেলে গেলো । পালাবে সে , বাড়ি থেকে পালাবে । বিয়ে নামক সামাজিক অসহ্যকর শিকলবাধা
একঘেয়ামি সংসার জীবনের প্রতি প্রচণ্ড বিরক্তিভাব সবসময়ই ছিলো ওর । নিজের
স্বাধীনতাটুকু এতো তারাতারি কখনোই নষ্ট হতে দিতে চায় না আনিলা । তাই পালানোর
সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ভাবতেই যেন আনন্দে মন ভরে গেলো । হ্যাঁ রাতেই,আজকে রাতেই পালাবে
সে । রাত ১২ টা বাজার পর , সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকবে তখনই সে নিঃশব্দে বের
হবে বাড়ি থেকে । নতুনভাবে ভিন্ন রকম স্বাধীনতার এক অজানা স্বাদ পাবার আশায় আনিলার
মন চঞ্চল হয়ে উঠলো ।
রাতের
খাবার দিয়ে গেলো হরিদাশ । আনিলা পাশের বারান্দা থেকে শুনতে পেলো বাবা ফোন এ কার
সাথে যেন কথা বলছে । কথার ধরন শুনে বুঝলো ছেলেপক্ষের সাথে । আনিলা রুমে এ গিয়ে খাবার খেয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মধ্যরাতের
প্রতিক্ষা করতে লাগলো । কয়েক মুহূর্ত পরে বিছানা ছেড়ে উঠে নিজের ব্যাক্তিগত পার্স
চেক করে দেখল ওতে বেশ কিছু খুচরা টাকা রয়েছে , এতেই চলবে । কিন্তু বাড়ি থেকে বের
হবে কি করে সে ? এ শহরের সবাই তো বাবাকে
চেনে । আনিলা কে দেখতে পেয়ে কেও যদি চিনে ফেলে তবে আর রক্ষা নেই । এসব ভাবতে
ভাবতেই চোখে একটু তন্দ্রার মতো আসে ।
বারান্দার
ঘরে রাখা মস্ত বড় দেওয়াল ঘড়িটার ডং ডং শব্দে আনিলার তন্দ্রা ভেঙ্গে গেলো । জানালা খুলে উকি দিয়ে বাইরের দিকটা একবার দেখে নিলো সে । ঘড়ির দিকে তাকালো একবার । রাত ১২ টা বেজে ১ মিনিট । ঘড়ির পেন্ডুলামটা তখনো নড়ছে । বাড়ির সদর দরজার সামনে দারোয়ান
বসে ঘুমুচ্ছে আর বারান্দায় কুকুরটাও সানন্দে ঘুমুচ্ছে । এই তো সুযোগ । আনিলা সন্ধ্যা
রাতেই ওর বাবার একটা শার্ট, একটা প্যান্ট আর একটা ক্যাপ এনে ওর ঘরে রেখেছিলো । সে
বাবার শার্ট,প্যান্ট গায়ে জড়ালো এবং ক্যাপটার ভেতর ওর লম্বা ঘন কেশ গুজে দিয়ে পুরুষের
মতো করে সেজে লাগেজের ভেতর কয়েকটা শাড়ি গয়না আর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভরে নিয়ে
আস্তে আস্তে দরজাটা খুলল প্রথমে । চারদিকটা একবার ভালো করে দেখে নিলো । সদর দরজা
দিয়ে বের হতে গেলে ধরা পরে যাবে তাই বাড়ির পেছনে বাগানের রেলিং টপকে বের হতে হবে । লাগেজ নিয়ে পা টিপে টিপে বাড়ির পেছনে বাগানের দিকে গেলো সে । এবার পরা
গেলো মহা বিপদে । কি করে এই উচু দেওয়াল টপকাবে সে ? কখনো তো এইভাবে দেওয়াল টপকানোর
মতো পরিস্থিতিতে তাকে পরতে হয়নি । মাথায় একটা চমৎকার বুদ্ধি
এসেছে । হাতের লাগেজটা রেলিং এ ঠেকিয়ে রেখে সে চলে গেলো বাড়ির সামনের একটা ছোট্ট ঘরের দিকে । গিয়ে সে একটা ভাঙ্গা চেয়ার আস্তে
করে নিয়ে এলো বাগানের পেছনের দিকে । এরপর চেয়ারের উপর উঠে প্রথমে লাগেজটা বাইরে
বের করলো । সাবধানে পা ফেলে এক লাফে দেওয়াল টপকে বাইরে বের হলো সে । রাস্তায় নামার
পর আনিলার মনে হলো যেন সে যুদ্ধ জয় করে ফেলেছে । অসস্তি,আর উত্তেজনায় আনিলার গা
গুলাতে শুরু করেছে । রাস্তার চারপাশ সুনসান ,কোনো জনমানব নেই । কিছুক্ষন দাড়িয়ে
থেকে হঠাৎ দেখতে পেলো দূর থেকে একটা ট্রাক দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে এদিকেই ।
নিশ্চয়ই ট্রাকটা মালামাল বোঝাই করে নিয়ে অনেক দূরে কোথাও যাচ্ছে । বাবার মুখে গল্প
শুনেছে অনেক রাতের ট্রাকগুলো মালামাল বোঝাই করে অনেক দূরে নিয়ে যায় । এক শহর থেকে
অন্য শহরে । একবার যদি উঠে পরা যায় তাহলেই আনিলা সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যাবে ।
ট্রাকটা কোনো একটা কারনে আনিলার সামনে এসেই থেমে গেলো কিন্তু ট্রাকের ড্রাইভার আনিলাকে দেখতে পেলো না । একটা গাছের
আড়ালে দাড়িয়ে আনিলা লক্ষ্য করছিলো ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার পাশে একটু
আড়ালে চলে গেলো । এই সুযোগে আনিলা ট্রাকের পেছনের চাকা ধরে অনেক কষ্টে ট্রাকের উপর উঠে পড়লো । এবার সে
সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত । ট্রাক চলা আরম্ভ করেছে । ট্রাকের মালামালের উপর গুটিশুটি হয়ে
বসে আছে আনিলা । চারপাশের বাতাস এসে ওর কানে কানে কি যেন একটা বলছে । রাস্তার
দুপাশের বিশাল বিশাল গাছগুলো যেন ওর দিকে খুব কঠিন দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে । আনিলার
ভয় ভয় লাগছিলো । কার্তিকের শেষ সময় চলছে ,হালকা হালকা শীত লাগছে । হাত ঘড়িটার দিকে
একবার তাকিয়ে দেখলো রাত ৩ টা বেজে ২৩ মিনিট । কিন্তু ট্রাক থেকে নামার পর কি হবে , কোথায় যাবে সে ?
আর ট্রাক যদি বেশিদূর না যায় ? পরিচিত কেউ যদি দেখে ফেলে ওকে দেখে তবে কি উত্তর
দেবে আনিলা ? এসব ভাবতে ভাবতে আনিলার চোখে ঘুম চলে এলো ।
এদিকে
শঙ্কর বোস সকাল বেলা আনিলার ঘরে দিয়ে দেখলো কোথাও নেই সে । সারা বাড়ি অনেক খোজাখোজির পরও খুজে পাওয়া গেলো না তাকে । হরিপদকে
পাঠানো হলো হোস্টেলে খোজ নেওয়ার জন্য কিন্তু সেখানেও পাওয়া গেলো না আনিলাকে ।
২.
-এই যে শুনছেন ?
-আনিলা চোখ কচলাতে কচলাতে ঘুম জরানো গলায় বললো –
কে ?
- আমার ট্রাকের উপর বসে আমাকেই প্রশ্ন করা হচ্ছে
?
- এই যে দিদি আপনি আমার ট্রাকের উপর কি করে এলেন
? আমার ট্রাকের মালপত্তর চুরি টুরির মতলব ছিলো
নাকি ? ড্রাইভার খুব রাগ নিয়ে বলল ।
- আনিলা থতমত খেয়ে চারপাশে বোকার মতো দৃষ্টি
দিয়ে একবার তাকিয়ে দেখলো সকাল হয়ে গেছে ।
এরপরই দেখলো সেই ট্রাক ড্রাইভার ভুরু কুচকে তার দিকে তাকিয়ে কি কি যেনো বক বক করে
যাচ্ছে । আনিলার সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই ।
ড্রাইভার আনিলার দিকে তাকিয়ে রাগে গজ গজ করতে
করতে বলল –
-সকাল সকাল আচ্ছা ঝামেলায় পরা গেলো তো ? নামুন,
নামুন বলছি ?
-ঠিক আছে ঠিক আছে নামছি , বলে আনিলা খুব বিরক্তি
নিয়ে ট্রাক থেকে নেমে গেলো । হাতে লাগেজ নিয়ে আনিলা রাস্তার এক পাশ দিয়ে আনমনে
হেটেই চলছে । কোনো লক্ষ্য উদ্দেশ্য কিছুই নেই । অনেক্ষন ট্রাকের মালামালের উপর বসে
থাকতে থাকতে পা দুটো যেনো ব্যাথায় টন টন করছে । খিদেও পেয়েছে ভীষণ । রাস্তার পাশের
একটা টঙ দোকান থেকে কলা আর ব্রেড কিনে নিয়ে খেতে খেতে হাটছে । এবার সে সম্পূর্ণ
মুক্ত । বাড়ি থেকে অনেকটা দুরের পথে চলে এসেছে সে । এখানে তাকে কেউ আর জ্বালাতে
আসবেনা । এসব ভেবে আনিলা মনে মনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো । সঙ্গে করে কিছু শাড়ি আর
গয়না নিয়ে এসেছে সে । গয়না বিক্রি করে সুন্দরভাবে থাকার রাস্তা খুজে নেবে । এখানে একটা
বসবাসের হোটেল অথবা একটা রিসোর্ট পেয়ে গেলে খুব ভালো হতো ।
জায়গাটা
খুব সুন্দর । চারপাশে উঁচু উঁচু পাহাড় আর পাহাড়ের বুক চিরে নেমে গেছে ঝর্না । ঝর্নার কাছে সমুদ্র সৈকতের মতো দেখা যাচ্ছে । কিনারায় কিছু স্পিড বোট রাখা
হয়েছে । পাশেই ফেরিওয়ালারা বিভিন্ন ধরনের জিনিস নিয়ে বসে আছে । আশেপাশে
তাবু টানিয়ে বসে আছে বিচিত্র সব মানুষ । ওঁদের কেউ কেউ আনিলার দিকে অদ্ভুত
চোখে তাকালো । আনিলার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই । এখানের কিছুই সে চেনেনা ।
তবুও চলছে উদ্দেশ্যহীন
পথে । অনেকক্ষণ হাটার পর সে একটা রিসোর্ট এর সন্ধান পেলো এবং ভেতরে ঢুকে
ম্যানেজারের সাথে কথা বলে একটা রুম ভাড়া নিয়ে নিলো । হাতে লাগেজ নিয়ে টলতে টলতে
নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে সে । পা দুটো যেন আর চলছেনা । রুমে এসেই একটা সস্তির
নিঃশ্বাস ফেলে ব্যাগ রেখে বিছানার উপর গা এলিয়ে দিলো । ঘুমে চোখ যেন জড়িয়ে আসছে । একটু চোখ বুজতেই বাবার
সেই শাসনে ভরা মুখটা ভেসে উঠলো । কে জানে
এতক্ষনে হয়তো বাড়িতে তাকে খোঁজার জন্য সবাই এদিক ওদিক ছুটছে । কিছুক্ষন বিশ্রাম
করার পর উঠে স্নান করতে চলে গেলো । মাথাটা ঝিম ঝিম করছে । সারাদিন খুব ধকল গেলো
শরীরের উপর দিয়ে । বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে নিচে দাঁড়াতেই ঠাণ্ডা পানির ধারা
অধর বেয়ে গলা,পৃষ্ঠদেশ স্পর্শ করে নিচে নেমে গেলো । শান্তির পরশ পেয়ে আনিলা
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো । টানা এক ঘণ্টা বাথরুমের ভেতর কাটিয়ে বের হলো । কেউ একজন নক করছে দরজায় । দরজা খুলে
দেখল একটা ১২/১৩ বছরের ছেলে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে দাড়িয়ে আছে ।
-
চা লাগবে দিদি ?
-
হ্যাঁ দিয়ে যাও । তোমার নাম কি ?
-
আজ্ঞে আমার নাম নরেন । চায়ের কাপটা টেবিল এর উপর রাখতে রাখতে বলল ছেলেটা ।
-
আমি এই হোটেলেই কাজ করি । কোনো দরকার পরলে আমাকে ডেকে নেবেন দিদি ।
-
ঠিক আছে ।
ছেলেটা চলে যাওয়ার পর দরজা আটকে আনিলা চা খেয়ে
একটু বাইরে ঘুরতে যাবে ভাবলো । ড্রেসিং
টেবিলের সামনে দড়িয়ে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রইল নিজের প্রতিবিম্বের উপর । একটা হালকা
নীল রঙের পাতলা শাড়ি আর ডার্ক পিংকের ভেতর লাইট ব্লু কালারের ব্লাউজ পরে কপালে
একটা নীল টিপ পড়ল । অসাধারন সুন্দর লাগছে তাকে , আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে মুচকি
হাসলো ।
তখন বিকেল
৫ টার মতো বাজে । আনিলা বাইরে বের হলো । চারদিকের মনোরম পরিবেশ আনিলাকে মুগ্ধ করলো
। বেশ কিছুক্ষন হাটার পর একটা দ্বিপের মতো দেখতে পেলো সে । দ্বিপের চারপাশে বড় বড়
পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । সবগুলো পাথরের মাঝে খুব সুন্দর একটা পাথর সে লক্ষ্য
করছিলো । পাথরের রংটা দেখে মনে হচ্ছিলো বিশেষ কোনো পাথর । সে ঐ পাথরের উপর বসে
হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা উপন্যাস বই বের করল । বইটা সম্ভবত সমরেশ মজুমদারের
“সপ্ন সন্ধানী”। বইয়ের
প্রচ্ছদের দিকেই বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে কি যেন ভাবছিলো সে । চারপাশের মৃদু বাতাসে ওর মেঘের মতো খোলা চুলগুলো অবাধ্য ভাবে মুখের
উপর আছড়ে পড়ছে বার বার । আনিলা চুলগুলো সরাতে চেষ্টা করেও ব্যার্থ হচ্ছে ।
উদাসিন
ভাবে বই পড়ছিল সে ,কয়েক মুহূর্ত পর বই থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল চারপাশে কেউ নেই । যেন
প্রকৃতি এই মনোহর পরিবেশে শুধু তারই জন্য অপেক্ষা করছিলো । এই নির্জন পরিবেশে
বাতাসের সাথে মিশে থাকতেই যেন সে এসেছে । বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই
একসময় কানে গিটারের আওয়াজ এলো । খুব কাছে থেকেই আসছে আওয়াজটা । আনিলা
উঠে দাড়িয়ে আঁচ করার
চেষ্টা করল । হেটে একটু
সামনে এগুতেই সে দেখলো মাথায়
একটা ক্যাপ,পায়ে কেডস, আর জিন্স টিশার্ট পরে কেও বসে আছে একটা উঁচু পাথরের উপর । আনিলা পেছন থেকে একবার দেখলো ভদ্রলোক
একমনে গিটার
বাজিয়েই চলছে । গিটারের আওয়াজটা তাকে তিব্রভাবে আকর্ষিত করলো । মনে হচ্ছে যেন অনেক দিনের
চেনা সে আওয়াজ , যেন
অনেক পরিচিত । সে কিছুক্ষন খুব মনোযোগ দিয়ে আওয়াজটা শুনছিলো । আনিলার ইচ্ছে হলো সেই
অচেনা আগন্তুকের পাশে বসে মুগ্ধ হয়ে
গিটারের সুর শুনতে । আবার ভাবতে লাগলো চেনেনা জানেনা এই ভদ্রলোকের পাশে বসবেই বা কেন সে ? এসব ঊল্টো
পাল্টা কথা ভেবে মনে মনে খানিকটা হাসলো সে ।
সূর্য ডোবার শেষ প্রহর চলছে । চারদিকের বাতাসটা
যেন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে । মাথার উপর দিয়ে বিচিত্র সব পাখি উড়ে চলে যাচ্ছে , হয়তো
নীড়ের দিকে । আনিলা সেখান থেকে উঠে রিসোর্ট এর পথে হাটা শুরু করল ।
৩.
-হ্যালো,মিস্টার মল্লিক বলছেন ?
-ইয়েস স্পিকিং ,।
-আমি শংকর বোস বলছি ।
-আরে মিস্টার বোস,কি সৌভাগ্য আমার , বন্ধুর খোঁজ খবর নেওয়া তো বন্ধই করে
দিয়েছেন একেবারে । তা এতদিন পরে কি মনে করে
?
জরানো গলায় বলল বোস –‘ মল্লিক আমার আপনার হেল্প দরকার’ ।
-আর ইউ ওকে মিস্টার বোস ?
-নো, আই এম নট ওকে । আমার মেয়েটা বাড়ি থেকে পালিয়েছে,আপনি যেভাবেই হোক আমার
মেয়েটাকে খুজে আনার ব্যাবস্থা করুন ।
-ঠিক আছে আপনি কোনো চিন্তা করবেন না , আমি পুরো শহরে লোক লাগিয়ে দিচ্ছি ।
আর আপনার মেয়ের একটা ছবি আমাকে দিতে হবে
মিস্টার বোস ।
-ঠিক আছে ,আমি
হরিদাশকে দিয়ে ছবি পাঠিয়ে দিচ্ছি ।
প্রকাণ্ড একটা বাড়ি মিস্টার
সুশান্ত মল্লিকের । খুব ক্ষমতাবান লোক মিস্টার মল্লিক । এ শহরের সবাই বাঘের মতো ভয়
পায় তাকে । লাগোয়া বারান্দায় বসে এক হাতে খবরের কাগজ ও অন্য হাতে সিগারেট নিয়ে খুব
মনোযোগ সহকারে চোখ রেখেছে খবরের কাগজের উপর । সামনেই একটা টি টেবিলে সিগারেটের
এসট্রে । মাঝে মাঝে পত্রিকা থেকে চোখ না সরিয়েই সিগারেটের ছাই এসট্রেতে ফেলার চেষ্টা করছে কিন্তু
ছাইগুলো এসট্রেতে না পরে এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে । কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই
তার । দেখে বোঝা যাচ্ছে নিশ্চয়ই কোনো উত্তেজনামূলক খবর পরছেন তিনি । গতকাল রাতে এ
শহরের মন্ত্রী খুন হয়েছে স্থানীয় স্মাগলারদের হাতে । ভাবা যায় ? একজন মন্ত্রী খুন হয়ে গেলো তাও কিনা স্থানীয়
স্মাগলারদের হাতে ? একজন মন্ত্রীর নিরাপত্তা এতো কম আর নড়বড়ে ? কি আশ্চর্য বিষয় !
দেশের মানুষগুলো আজকাল এতটাই অলস হয়ে পরেছে যে নিজের নিরাপত্তাও নিজে কিভাবে দিবে
সেটা বুঝতে পারে না । মিস্টার মল্লিক খবরটা দেখে ভয়ে শিউরে উঠলেন । এবার নির্বাচনে
মিস্টার মল্লিকের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল শহরের খুন হয়ে যাওয়া সাবেক মন্ত্রী । যদি
মিস্টার মল্লিক এখন মন্ত্রীর জায়গায় থাকতো, যদি নির্বাচনে জয়টা মিস্টার মল্লিকের
হতো, তাহলে হয়তো এই খবরের কাগজে এতক্ষনে মিস্টার মল্লিকের মৃত্যুর খবরটা এইভাবেই
বসে বসে পড়তো খুন হয়ে যাওয়া সাবেক মন্ত্রী । এসব ভাবতে ভাবতে কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে
পড়ছে মিস্টার মল্লিকের । সিগারেটও ধ্বংস করে যাচ্ছেন তিনি একের পর এক । এমন সময় একটা
কালো মোটাসোটা ভুঁড়িওয়ালা ভয়ঙ্কর চেহারার লোক সুশান্ত মল্লিকের পাশে এসে দাঁড়ালো ।
পৃথিবীর বেশির ভাগ ভুঁড়িওয়ালারা বোধহয় দেখতে কালোই হয় । লোকটিকে দেখলেই বোঝা যায়
মায়াদয়াহীন একটা মানব । লোকটি মল্লিকের দিকে হাত বাড়িয়ে খেশ খেশে মোটা আওয়াজে বলল-
স্যার, একটা লোক আপনাকে জন্য এই খাম টা দিয়ে
গেছে ।
- কিসের খাম ? নিজেকে সামলে নিয়ে খবরের
কাগজ থেকে চোখ না তুলেই প্রশ্ন করলো মিস্টার মল্লিক ।
-জানিনা স্যার, হরিদাশ নামের একজন
এসে দিয়ে গেলো ।
-ও আচ্ছা, ঠিক আছে ।
কয়েক মুহূর্ত পর ঐ ভুঁড়িওয়ালা লোকটিকে মিস্টার
মল্লিক বলল ,খাম টা খোল তো দুস্মন্ত ?
খাম খুলে একটা ছবি মিস্টার
মল্লিকের হাতে দিলো দুস্মন্ত নামের ভুঁড়িওয়ালা লোকটা । মিস্টার মল্লিক দুস্মন্তের দিকে লক্ষ্য করে বলল-
-হুম,এই মেয়েটাকে খুজে বের করার ব্যাবস্থা কর । শহরের চারপাশে লোক লাগা ,
আর শহরের বাইরেও আমার লোক পাঠানোর
ব্যাবস্থা কর ।
-ঠিক আছে স্যার ,আমি সব ব্যাবস্থা করছি ।
মল্লিকের সাঙ্গ পাঙ্গরা আনিলার ছবি
নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় খুজতে বের হলো । পুরো শহর এবং শহরের বাইরে আনিলাকে খুঁজতে বের
হলো আট জোড়া চোখ । দুস্মন্ত, ভোলা,বাঘা,কাটারিয়া,গর্জন,সঞ্জিত আরও অনেকে । সবার মাঝে বুদ্ধিমান হলো দুস্মন্ত
ভুঁড়িওয়ালা । সেজন্যই মনিব মিস্টার
মল্লিক তার সাথেই সবার আগে এসব কাজের বিষয়গুলো আলোচনা করে , এরপর সে গিয়ে অন্যদের
নেতৃত্ব দেয় এবং তার কথামতো সবাই চলে ।
৪.
আনিলা রিসোর্টের বারান্দায় দাড়িয়ে
আকাশ দেখছিলো । সে বিশ্বাস করে আকাশ দেখলে মনটাও আকাশের মতো উদার হয়ে যায় । হালকা
নীলচে আভার মাঝে টুকরো টুকরো সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে । একবার তার মনে হলো
যদি আকাশের ঐ মেঘ হতে পারতো সে । এমন সময় ঘড়ের দরজার কলিংবেলটা কর্কশ শব্দে বেজে ঊঠলো । আনিলা ধীর পায়ে
এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখতে পেলো টি শার্ট, জিনস,আর মাথায় ক্যাপ পরিহিত একজন
সুদর্শন পুরুষ তার দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে । যুবকটির চোখে মুখে দৃঢ় বুদ্ধির আর
প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের
ছাপ । যুবকটিকে দেখে আনিলার মনে হচ্ছিলো সে যেন তার অনেক দিনের চেনা কেঊ ।
যুবকটি মৃদু হাসিমাখা মুখে আনিলার
দিকে তাকিয়ে বলল - স্বপ্ন সন্ধানী ?
আনিলা খানিকটা অবাক হলো ।
ছেলেটা এরপর একটা বই আনিলার দিকে
এগিয়ে দিয়ে বলল
- বইটি সম্ভবত
আপনার । কাল বিকেলে জলার ধারে একটা পাথরের উপর এই বইটি বোধহয় আপনিই ফেলে এসেছিলেন । আমি বইটির ভেতরের একটা পাতা খুলে কলমে লিখা একটা
নাম দেখতে পেলাম , এরপর খুজে খুঁজে এই পর্যন্ত ।
আনিলা সামান্য হেসে বলল- ও
হ্যা,এটা আমারই বই । আপনাকে অনেক থ্যাংকস ।
যুবকটি বলল,সমরেশ মজুমদার অনেক
পছন্দের লেখক ?
- হ্যাঁ অনেক বই পড়েছি উনার, বেশ ভালই লিখেন ।
- বাই দ্যা ওয়ে, আমার নাম স্বপ্নময় । আমি এই রিসোর্টের
অদূরেই থাকি , আপনি তো বোধহয় সেই পাথর
দ্বীপের ধারে যান ।
আনিলা বলল ,আসলে কালকেই আমি এই
রিসোর্টে এসেছি ,তাই আশেপাশে একটু ঘুরে দেখতে বেরিয়েছিলাম আর কী । এর পর একটু
ব্যস্ত হয়ে বলল –দেখুন না আপনাকে বাইরে দাড় করিয়ে রেখেছি আসুন,ভেতরে আসুন ?
যুবকটি ব্যস্ত হয়ে বলল - না ঠিক আছে , আজ থাকুক অন্য একদিন । আমি সেই পাথর
দ্বীপেই বেশি সময় কাটাই । আশা করছি পেয়ে যাবো আপনাকে সেখানে কোনো একদিন ।
আনিলা মুচকি হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা
নেড়ে বলল – নিশ্চয়ই ।
যুবকটি চলে গেলো । আনিলা পেছন থেকে
দেখে অবাক হয়ে গেলো । ইনি সেই গিটারিস্ট ।
দরজা বন্ধ করে এসে বিছানায় শুয়ে অজান্তেই যুবকটির কথা ভাবতে লাগলো । এমন কেন লাগছে তার ? আগে
তো কখনো এভাবে কোনো ছেলেকে ভাবেনি সে । আসেওনি কোনোদিন কোনো ছেলে আনিলার চিত্তে । যুবকটির চোখের ক্ষীণ দৃষ্টি সে কিছুতেই ভুলতে
পারছে না । বান্ধবিদের তো কতজনই কতো প্রেম করে বেড়াতো । ওর কখনো এসব বিষয়ে কোনো
আগ্রহই ছিলো না । অবশ্য অনেক বান্ধবিদের অনেক প্রেমপত্র লিখে দিয়েছে আনিলা । সে
জন্য বান্ধবিরা আনিলাকে দুষ্টুমি করে প্রেমপত্রাসিনী
বলে ডাকতো । কেন যেন সেদিন রাতে ভালো ঘুম হলো না আনিলার ।
পরদিন বিকেলে একটা লাল শাড়ি কপালে
লাল টিপ পরে আনিলা বাইরে বের হলো । হাটতে হাটতে সেই পাথর দ্বিপের কাছে পৌঁছে গেলো
সে । পাথরগুলো আজকে যেন অনেক বেশি প্রানবন্ত দেখাচ্ছে । মনে মনে সে যুবকটিকে
খুজতে লাগলো । এরপর আশেপাশে একটু তাকিয়ে সেই পাথরের উপর বসলো । কয়েক মুহূর্ত পর –
‘‘ তোমায় দেখেছি আমি নিলাভ শিখায়
দেখেছি নতুন রক্তিম আভায়,
তুমি কি সেই সুনয়না ?
নাকি আমার দেখা অদৃশ্য এক আনিলা ।’’
পেছন থেকে কবিতার লাইনগুলো বলতে বলতে আনিলার
পাশে এসে বসলো সপ্নময় । আনিলা বলল- কবিত্ব গুনটা ভালোই বোঝা যাচ্ছে ,সপ্নময় হেসে ফেলল আর বলল –সুন্দর কিছু চোখে
পড়লে কবিত্ব এমনিতেই চলে আসে ।
আনিলা নিচের দিকে চেয়ে লজ্জা পেয়ে
একটু হাসল এরপর বলল
- তা আপনার কবিতায় আনিলা অদৃশ্য
কেন ?
- কারন এতক্ষন অদৃশ্যে ছিলো তাই ।
আনিলা মৃদু হেসে বলল-
অদৃশ্যেও খুঁজেছেন বুঝি তাকে ?
-হুম খুজলাম ।
-কেন ? আনিলা কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন
করলো ।
আনিলার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে
সপ্নময় একটু দীর্ঘশ্বাস নিয়ে পরক্ষনেই বলে উঠলো
- আচ্ছা ,আজকে আপনার স্বপ্ন সন্ধানী কই ?
- আমার সপ্ন সন্ধানী ঘুমুচ্ছে , বলে আনিলা প্রান
খুলে হেসে উঠলো ।
আনিলার হাসির শব্দে চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠলো । দ্বিপের চারপাশের জ্বলে
যেন ঢেউ খেলে গেলো । রক্তে রাঙ্গা শিমুল ফুলের মতো দুই ঠোটে যেন তার কেপে কেপে
উঠছিলো । সপ্নময় এক দৃষ্টে আনিলার দিকে চেয়ে ছিলো । হাসলে অপূর্ব দেখায় মেয়েটাকে ।
সপ্নময় অজান্তেই বুকের ভেতর একটা অস্থিরতা অনুভব করছিলো । হাসতে হাসতে একসময় আনিলা
লক্ষ্য করলো সপ্নময় তার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে । আনিলা নিজেও কয়েক মুহূর্ত
সপ্নময়ের দিকে পলকহীন চোখে তাকালো । সপ্নময়ের চোখপানে তাকিয়ে আনিলার মনে হলো সে
বিশাল একটা আকাশ দেখছে আর সেই আকাশে আনিলা মুক্ত পাখির মতো ভেসে বেড়াচ্ছে । হঠাৎ
একটা পাখি খুব কর্কশ স্বরে ডেকে উঠলো । আর তখনই তাদের মোহ ভাঙল আর দুজন দুজনকে
সামলে নিলো । আনিলার ভীষণ লজ্জা লাগছিল । তার মনে হচ্ছিলো বেশিক্ষণ আর সপ্নময়ের
সাথে থাকতে পারবেনা সে । পরিস্থিতি সহজ করার জন্য স্বপ্নময় বলে উঠলো –
আপনার আকাশ ভালো লাগে ?
–
অনেক । আকাশে মেঘ হয়ে ভেসে বেড়াতেও ভীষণ ভালো লাগে । বলে আনিলা অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো
।
সপ্নময় বলল- সত্যি সত্যিই ভেসে
বেড়ান ?
- নাহ,কল্পনায়
- বাহ, খুব প্রখর তো আপনার কল্পনাশক্তি
- বাস্তবে যা করা যায় না তাই তো মানুষ কল্পনায় সফল করে
সস্তি পায়, আনিলা বলল ।
- হুম,বলল সপ্নময় ।
নিজেকে আর একটু সহজ করে আনিলা
সপ্নময়কে বলল-
- ভীষণ ভালো গিটার বাজান আপনি
সপ্নময় আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলো - আমি গিটার বাজাই আপনি জানেন কি করে !
আনিলা বিজ্ঞের মতো মুখভঙ্গিতে বলে
উঠলো – জানি জানি
আনিলা কিভাবে জানলো সে গিটার বাজায়
এই বিষয়টা সপ্নময়ের কাছে পরিষ্কার , তাই তাকে আর এই বিষয়ে প্রশ্ন না করে বলে ঊঠলো
- এই আর কি ,খুবই সামান্য ,
মিউজিক নিয়ে কিছু করার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু পরিস্থিতি আর সময়ের অভাবে হয়ে উঠেনি ।
- আমাকে শোনাবেন একদিন ?
- কি ?
- গিটার
-হুম নিশ্চয়ই শোনাবো ।
আনিলা মুচকি হাসল ।
সপ্নময় দ্বিপের পাথরগুলোর দিকে লক্ষ্য করে বলল -এইসব ছোট ছোট পাথরের উপর
দিয়ে হেঁটেছেন কখনো ?
- নাহ, কিন্তু ইচ্ছে করে হেটে বেড়াই ।
- হাটবেন এখন ?
-হূম ,খূব আগ্রহ নিয়ে বলল আনিলা ।
অসংখ্য ছোটো ছোটো পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চারপাশে । দুজন মিলে হাটছে
পাথরের বুকের উপর দিয়ে । আনিলার খুব ইচ্ছে করছিলো স্বপ্নময়ের হাত ধরে হাটতে ।
প্রকৃতিও যেন তাই চাচ্ছে । সামনে থেকে বাতাস এসে আনিলার সারা গায়ে লেপটে আছে পাতলা
ফিনফিনে লাল শাড়ি । বাতাসের স্পর্শে এক অন্যকম শিহরন অনুভব করলো আনিলা । হঠাৎ একটা
পাথরের উপর আছার খেয়ে পরে যাচ্ছিলো আনিলা কিন্তু তখনি পাশ থেকে সপ্নময় ধরে ফেলল
তাকে । সে সোজা গিয়ে পড়লো সপ্নময়ের বুকের
উপর । নিজেকে কোনোরকম সামলে
নিয়ে বলে উঠলো আনিলা
-
সরি
-
মৃদু হাসতে হাসতে
সপ্নময় বলল, ঠিক আছে ।
আনিলা ভীষণ লজ্জা পেলো সেই মুহূর্তে । এরপর বলল – সন্ধ্যে হয়ে গেছে , ফিরতে
হবে ।
-
ঠিক আছে চলুন আপনাকে
এগিয়ে দিয়ে আসি
-
ওকে, বলল আনিলা ।
পাহাড়ের সরু পথ ধরে হেটে যেতে যেতে সপ্নময় প্রশ্ন করলো আনিলাকে
-
আচ্ছা,আপনি এখানে একা
কেনো,আপনার পরিবার ?
-
পরিবারে বাবা ছাড়া আর
কেউই নেই । মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দিতে চাচ্ছিলো তাই বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি ।
সপ্নময় খুব জোরে জোরে হাসতে লাগলো ।
-
হাসছেন যে ?
হাসি না থামিয়েই
সপ্নময় বলে উঠলো , বেশ সাহসী মেয়ে তো আপনি ?
– এ ছাড়া আমার আর কোনো রাস্তা ছিলো না ।
সপ্নময় তখনও হাসছে আর
বলছে, কে জানে আপনার হবু বর বেচারার কি অবস্থা হয়েছে আপনি পালানোর পর ,
-
যা হবার হোক তাতে আমার কি ? আনিলা
হাসি আর বিরক্তি দুটো মিশিয়েই বলল।
-
হুম,এবার রুমে গিয়ে দেখুন আপনার
সপ্ন সন্ধানির ঘুম ভেঙ্গেছে কিনা ।
-
হাসিমাখা মুখে আনিলা বলল – ঘুম
ভাঙলে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিবো ?
-
কেনো ?
-
কারন জেগে থাকলে সে সপ্ন দেখতে
পাবে না ।
-
সপ্নময় বলল , আপনি কি সত্যি সত্যি
সপ্ন দেখতে চান ?
-
হুম চাই তো ।
-
এরপরই হাসতে হাসতে আনিলার
রিসোর্টের দিকে ইশারা দিয়ে দেখিয়ে সপ্নময় বলল, এই যে দেখুন আপনার স্বপ্নের রিসোর্ট
।
আশ্চর্য আনিলা লক্ষ্যই
করেনি যে সে রিসোর্টের সামনে এসে গেছে । ওর ইচ্ছে হলো আরও কিছুক্ষন সপ্নময়ের সাথে
থাকতে । কিন্তু মনের বিরুদ্ধে সে তার রুমে চলে গেলো ।
আনিলার যাওয়ার পথের
দিকে তাকিয়ে সপ্নময় কাব্যিক সুরে বলে উঠলো –
“ তার বিদায় বেলার এই ক্ষণে
লক্ষ কোটি শিমুল পলাশ
দিয়েছি বিছিয়ে তার চরণও তলে ’’
আনিলা কবিতা শুনে এক
মুহূর্ত পেছন ফিরে মুচকি হেসে চলে গেলো । সপ্নময় বাতাসের সাথে মিশতে মিশতে তার
গন্তব্যের দিকে যেতে লাগলো ।
৫.
রাতের খাবার শেষ করে বিছানায় শুয়ে
সপ্ন সন্ধানী বইটা হাতে নিয়ে একটু হাসলো আনিলা । বইয়ের কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পর বইটা হাত থেকে নামিয়ে বিছানায় রেখে চোখ বন্ধ করতেই
বাবার কথা মনে পড়লো । বাবা কি তাকে খুজতে এখানে চলে আসবে ?
আসুক কোনো ক্ষতি নেই তাতে । কিন্তু আবারো কি জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে ?
কেনো তাকে বুঝতে চেষ্টা করেনা বাবা ? পৃথিবীতে
বাবা ছাড়া আর কারোর ছায়ায়
সে বড় হয়ে উঠতে পারেনি । কখনই সে সুযোগটা হয়নি মায়ের মতো কারোর আচলে মুখ লুকিয়ে
কাঁদতে । মেয়েরা বোধহয় চিরকালই পর হয় । কিন্তু আজ বাবার প্রতি অনেক বেশি অভিমান থাকায় ফিরে যাওয়ার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা তার
নেই । ফিরে গেলে নিশ্চয়ই বাবা আবারো জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে । কাটুক না
সময় যেভাবে কাটছে । একলা থেকেও মাঝে মাঝে মনে মনে অনেকগুলো মুখচ্ছবি তৈরি করে
নেওয়া যায় । আনিলা জানে একলা থাকার আনন্দ কতটা উপভোগ্য । নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা
থেকে বুঝেছে একলা মানুষ আসলে একলা হয় না বরং একলা থাকলেই স্বাধীনতা খুজে পাওয়া যায়
। আর স্বাধীন জীবনের চেয়ে সুখের আর কিছুই হয় না । তার ভাগ্য আর পরিস্থিতি সে নিজে
তৈরি করেছে । তার জীবনে সুন্দর মুহূর্ত বলতে শুধুমাত্র হোস্টেলে বান্ধবিদের সাথে
কাটানো সময়গুলো । এই অচেনা জায়গাটাতে এসে সে জীবনের সঠিক অর্থ খুজে নিতে চায় । বাবার
কথা মেনে নিলে সেটা হয়তো সম্ভব হতো না ।
কেন জানি খুব মন খারাপ আনিলার । এই
সময় তাকে বোঝার মতো কেউ যদি থাকতো পাশে ? ঘুমও আসছেনা না । তাই বিছানা থেকে উঠে
টলতে টলতে এক কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো । হালকা বাতাসের ঝাপটায়
চুলগুলো উড়ছে তার । আকাশে অর্ধচন্দ্র । কফিতে চুমুক দিতেই তার হঠাৎ চোখ পড়লো রিসোর্টের সামনের নারিকেল গাছটার নিচে ।
গিটার হাতে বসে আছে কেউ একজন । কে ? সপ্নময় ? এতো
রাতে এখানে ? আনিলা অবাক চোখে তাকালো । সপ্নময় আনিলার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে হাত
নেড়ে তার উপস্থিতি বুঝালো । এক মুহূর্তে আনিলার সব দুশ্চিন্তা আর কষ্টগুলো যেন
কোথায় মিলিয়ে গেলো । কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের আলোয় অপূর্ব এক পরিবেশ সৃষ্টি
হয়েছে চারপাশে । আনিলা সপ্নময়কে যতই দেখছে ততোই যেন সে মুগ্ধ হচ্ছে । কি আছে
ছেলেটার মাঝে ? দেখলেই সব কিছু ভুলে শুধু তার মাঝে ডুবে থাকা যায় । সপ্নময় কি শুধু
তার জন্য এতো রাতে এখানে ছুটে এসেছে ? ভাবতেই আনিলার হৃদপিণ্ডে কম্পন সৃষ্টি হয় । কিন্তু
কেন ? কেন হচ্ছে এমন তার ? সপ্নময়কেই কেন সে বার বার অনুভব করছে । নারিকেল গাছটার নিচে বসে সপ্নময় গিটার বাজানো
শুরু করলো । গিটার এর সাথে গান গাইছে সে -
আমারও পরানও যাহা চায়,তুমি তাই তুমি তাই
গো, , ,
আমারও পারণও যাহা চায় , , , ।
আনিলা বারান্দার রেলিং এ হাত
ঠেকিয়ে দাড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনছে সপ্নময়ের গান ।
৬.
টেলিফোন
হাতে নিয়ে বিষণ্ণ মুখে বারান্দায় বসে আছে মিস্টার বোস
একটা ফোন
এলো-হ্যালো মিস্টার মল্লিক ?
-
হ্যাঁ মিস্টার বোস , আমি খুবই দুঃখিত , আমি আপনার মেয়ের কোন খোঁজ পেলাম না
। আমি পুরো শহর তোলপাড় করে ফেলেছি কিন্তু কোথাও পেলাম না ।
গম্ভীর মুখে বোস বলল –
-
ঠিক আছে । আমি নিজেই দেখছি ।
ফোন কেটে
দিয়ে মিস্টার বোস
No comments:
Post a Comment